Blog Archive

Written By Bangladeshi on Wednesday 1 March 2017 | 06:10

ফাসির মঞ্চ থেকে বলছি [Fasir Monch Theke Bolchi]


ডাউনলোড

তাঁকে ফাঁসি দেওয়ার প্রায় বছর খানেক আগে ১৯৬৫ সালে মিশরের সামরিক কারাগারে বসে বইটি তিনি লেখেন। এটা তাঁর লেখা জীবনের সর্বশেষ বই।
আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে এতে। বইটি তিনি এমন এক সময়ে লিখেছেন যখন ইখওয়ান মিশরের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছিল এবং আন্দোলনের হাজার হাজার কর্মী জেলে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, শহীদ করা হয়েছিল অনেক নেতা-কর্মীকে। সর্বোপরি ইখওয়ান ছিল নিষিদ্ধ। পূর্বপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন সহিংসতা ঘটিয়ে ইখওয়ানের উপর তার দায় চাপিয়ে দিচ্ছিল সরকার। ইখওয়ানের ইমেজকে নানা ভাবে ক্ষতবিক্ষত করার চেষ্টা অব্যাহত ছিল। বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা ইখওয়ানের মতো ততটা নাজুক না হলেও একটা মিল কিন্তু রয়েছে। বিগত যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি কঠিন সময় পার করছে আন্দোলন। এই পরিণতির জন্য আন্দোলনের ভেতর ও বাইরের নানা শক্তি দায়ী। এই পরিস্থিতিতে সাইয়েদ কুতুবের এই বইটি বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য পাথেয় হতে পারে।
মিশরের তৎকালীন ঘটনাপ্রবাহ ও ইখওয়ানের আন্দোলনের ধারাক্রম মোটামুটি জানা থাকলে বইটা পড়ে বুঝতে সুবিধা হবে। তবে জানা না থাকলেও বইটার মূল ম্যাসেজ ধরতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ, তৎপরতা, অদ্ভূত কর্মকৌশলের কারণে আন্দোলন সম্পর্কে নতুন যে দৃষ্টিভঙ্গি নিজের মধ্যে আবছাভাবে তৈরি হয়েছে, তা আরো পোক্ত হয়েছে এ বইটা পড়ার পর।
ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে সাইয়েদ কুতুবের দৃষ্টিভঙ্গি
‘ইখওয়ান সম্পর্কে দীর্ঘ গবেষণার পর এবং আন্দোলনকে ইসলামের প্রথম আন্দোলনের সাথে তুলনা করার পর’সাইয়েদ কুতুব বলছেন, ‘ইসলামের সূচনাতে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে সমস্ত মানবগোষ্ঠী ইসলামের বিরোধিতা করেছিলো, অনুরূপ আজ এই আন্দোলনের বিরুদ্ধেও সমস্ত অশুভ শক্তি ঐক্যবদ্ধ। তারা বিভিন্ন কুটিল ষড়যন্ত্র করে ইসলামী আন্দোলনের অকাল মৃত্যুর প্রহর গুনছে এবং এই লক্ষ্যে দেশীয় ব্যবস্থা ও উপকরণকে ব্যবহার করছে। এই কারণে ইসলামী আন্দোলন সমূহকে অধিকাংশ দেশীয় রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে প্রতিদ্বন্দিতায় লিপ্ত থাকতে হয়। ইসলামী আন্দোলন দেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার আওয়াজ তোলে। অথচ তারা ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত মহল ইসলাম সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান থেকেও বঞ্চিত। তাই ইসলামী আন্দোলন সমূহকে এক অভিন্ন মূলনীতি নিয়ে কাজ করতে হবে। তাহল প্রথমে মানুষের মন ও মস্তিস্কে ইসলামের বীজ বপন করা, যারা তাদের দাওয়াত গ্রহণ করবে তাদেরকে ইসলামী ভাবাদর্শে আদর্শবান করা। প্রচলিত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সময় ব্যয় না করা এবং সমস্ত মানুষের অন্তর ইসলামী হুকুম গ্রহণের জন্য প্রস্তুত না করা পর্যন্ত ক্ষমতার জন্য শক্তি ব্যবহার না করা অত্যাবশ্যকীয়। সাথে সাথে বহির্শক্তির আক্রোশ থেকে আন্দোলনকে রক্ষা করতে হবে। এবং আন্দোলনের নেতা-কর্মী ও তাদের পরিবার যেন শত্রুর কাছে অত্যাচারিত না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।’[পৃষ্ঠা-১৬]
১৯৬২ সালে কারাগারের হাসপাতালে বসে তার সাথে একমত পোষণকারীদের নিয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ইখওয়ান থেকে বের না হয়েই আলাদা একটা আন্দোলন গড়ে তোলেন কুতুব। তবে তিনি আন্দোলনের নির্দিষ্ট কোন নাম বা সংগঠন কায়েম করেননি। তিনি চেয়েছিলেন, ইখওয়ান তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করুক। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি ইখওয়ানে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত কানাতারে (জেলখানায়) অবস্থিত ইখওয়ানরা তিনভাগে বিভক্ত হল। ৫০ জন আমার পদ্ধতিকে মেনে নিয়েছে। ২৩ জন প্রত্যাখ্যান করেছে আর ৫০ জন নির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি।’ [পৃষ্ঠা-১৮] বিরোধী ইখওয়ানরা এটাকে আন্দোলনে গ্রুপিং সৃষ্টির পাঁয়তারা বলে প্রচার করেছে বলে লেখেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলনের রূপরেখা
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিরাজমান পরিস্থিতির আলোকে ইসলামী আন্দোলনের জন্য জেলখানায় বসে তিনি একটি রূপরেখা তৈরি করেন। সমকালীন যে কোন আন্দোলনের রূপরেখা এরকমই হওয়া উচিত বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। বইয়ে তিনি ৬টি পয়েন্টে এ রূপরেখা উল্লেখ করেন:
১। বর্তমান মানব সমাজগুলো ইসলাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাই সর্বপ্রথম ইসলামের মর্মকথা মানুষের অন্তরের গহীনে প্রবিষ্ট করাই ইসলামী আন্দোলনের মূল শ্লোগান হওয়া উচিত।
২। যারা এতে সাড়া দিবে তাদেরকে ইসলামী নীতি-নৈতিকতা, ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস ও অন্যান্যদের সাথে ইসলামের ব্যবহার নীতির শিক্ষা দিতে হবে এবং আন্দোলনের পথে পথে শত্রুদের প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে সজাগ করতে হবে।
৩। ইসলামী আচার-আচরণ, ইসলামী চরিত্র ও ইসলামী আক্বীদা সম্পর্কে সম্যক অবগত বিপুল কর্মী ব্যতীত সংগঠনের কোন কাজ শুরু না করা।
৪। প্রথমে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার রব না তুলে শাসক-শাসিতসহ গোটা সমাজকে ইসলামের সঠিক তাৎপর্যের দিকে ফিরিয়ে আনার আওয়াজ তুলতে হবে এবং এমন এক পদ্ধতির অনুকরণ করতে হবে যে পদ্ধতিতে সমস্ত মানুষকে পরিব্যপ্ত না করা গেলেও এমন কতক মানুষকে পরিব্যপ্ত করতে হবে যাদের প্রভাবে সমাজ প্রভাবিত হয় এবং যাদের কথায় মানুষ ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার প্রতি লালায়িত হয়।
৫। ক্ষমতাসীন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারা বিপ্লব ঘটিয়ে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়; বরং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-চেতনায় এমন পরিবর্তন সাধন করতে হবে যাতে সমাজ নিজ প্রয়োজনে ইসলামী জীবন-বিধানকে রাষ্ট্রীয় বিধান করতে বাধ্য হয়।
৬। এই রকম ইসলামী আন্দোলন, যে আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল জুলুমের আশ্রয় না নেয়া এবং নিজ মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তির ব্যবহার না করা। তবে আন্দোলন ও আন্দোলনের কর্মীদের উপর থেকে জালেমের জুলুম প্রতিহত করার জন্য সম্যক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। [পৃষ্ঠা-২২]
সর্বশেষ গ্রেফতারের আগে ১৯৬৪ সালে কিছু দিনের জন্য জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সাইয়েদ কুতুবের সাথে ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান, আলজেরিয়া প্রভৃতি দেশের ইখওয়ান প্রতিনিধি ও ইসলামী মনোভাবাপন্ন মানুষজন বিভিন্ন সময় দেখা করেন। তাঁরা তাঁর কাছে নিজেদের দেশের অবস্থা ও আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি তুলে ধরে তাঁর নিকট দিক-নির্দেশনা চাইলে সবাইকেই তিনি মূলত যে কথাগুলো বলতেন, তার সারমর্ম ছিল, ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার পূর্বে মজবুত ইসলামী আক্বীদা বিস্তার করতে হবে। দল গঠনের পূর্বে ব্যক্তি গঠনের প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে।উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারা বিপ্লব ঘটিয়ে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা ত্যাগ করতে হবে এবং বিরাজমান দেশীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকতে হবে।
অধঃপতনের জন্য শাসন ব্যবস্থা নয়, শাসকরাই দায়ী!
পুরো বইটি আমি এক নিঃশ্বাসে পড়ছিলাম। কিন্তু ৪৭ পৃষ্ঠায় এসে থেমে গেলাম। তিনি বলেছেন, ‘অধঃপতনের জন্য এই দেশ ও এই দেশে দীর্ঘদিন থেকে প্রচলিত শাসন ব্যবস্থা কখনো দায়ী নয়; বরং সেই শাসন ব্যবস্থার শাসকরাই দায়ী। তাই পৃথিবীর প্রত্যেক শাসন ব্যবস্থা বিশেষত অভিজ্ঞতার আলোকে প্রণীত শাসন ব্যবস্থা যতটুকু শক্তির প্রতি মুখাপেক্ষী তার চেয়ে অধিক মুখাপেক্ষী চরিত্রবান, আদর্শবান ও নীতিবান শাসকের প্রতি। কারণ দেশের শত্রুরা আদর্শগত ও চরিত্রগত অধঃপতিত সমাজ থেকে খুব সহজে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারে। আমার উক্ত কথাগুলো কারো কারো জন্য শ্রুতিকটু হলেও আমি তা বলে যাচ্ছি। কারণ আমার দায়িত্ব হলো পৌঁছিয়ে দিয়ে কর্তব্য পালন করা।’
সাইয়েদ কুতুব ইখওয়ানের ভেতরে থেকেই যে আলাদা আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন, সশস্ত্র প্রতিরোধও তার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এজন্য কেউ কেউ তাঁকে উগ্রপন্থার জন্য দায়ী করেন। কুতুব এর জবাব দিয়ে গেছেন এভাবে:১৯৫৪ সালে ইখওয়ানকে ফাঁসানোর জন্য পূর্বপরিকল্পিতভাবে সাজানো আলেকজান্দ্রিয়ার ঘটনার অজুহাত তুলে দেশীয় শাসন পরিবর্তনের জন্য ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে অন্যান্য অভিযুক্ত মহলকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ইখওয়ানের নেতা-কর্মীদের সাথে যে রকম নৃশংস আচরণ করা হয়েছে তারই প্রেক্ষিতে আমরা ভবিষ্যতে এই রকম অন্যায়ের প্রতিরোধ শক্তি দ্বারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদি আমাদের সামান্যতম এই বিশ্বাস থাকত যে, এসব জেল-জুলুম ন্যায়ভিত্তিক বিচারে এমনকি মানব রচিত আইনের আলোকে হলেও নিস্পত্তি হবে। তাহলে কেউ সেই প্রতিরোধের সিদ্ধান্তের প্রতি সর্মথন জানাতো না। আমি জানি, এই বাস্তব সত্য কথা বলে এখন কোন লাভ নেই। তবুও আমার শেষ কথায় তা লিপিবদ্ধ করে দিলাম।’ [পৃষ্ঠা-৪৬]
মিশরে তখন সামরিক শাসন ছিলো। স্বাভাবিক বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিলো না।
বইটির শেষ বাক্যটি খুবই উদ্দীপ্তপূর্ণ। শহীদ কুতুব লিখেছেন, এগুলো এমন এক ব্যক্তির কথা যে ইখলাসের সাথে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে যাচ্ছে এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজ দাওয়াত পৌঁছাতে নিরত রয়েছে।


সাইয়েদ কুতুবের বই 
হাসান আল বান্না 
সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ

0 comments:

Post a Comment

E Boi Download© 2014. All Rights Reserved. Template By Seocips.com
SEOCIPS Areasatu Adasenze Tempate Published By Kaizen Template